'বন্দে মা-ত-র-ম' আওয়াজটা কোন্ অঞ্চলের এবং কার কণ্ঠ থেকে প্রথমে বের হয়েছিল, কারো জানা থাকলে থাকতে পারে অথবা খুঁজলেও পাওয়া যেতে পারে, তবে সেটা কোনো বিষয় নয়। 'বন্দে'-র অর্থ বন্দেগি, দাসত্ব, বন্ধন না-কি অন্য কিছু কিংবা 'মা-ত-র-ম' শব্দটিকে কোন্ অর্থে ব্যবহার করা হয়েছিল, তা নিয়ে অতি-উৎসাহীরা গবেষণায় লিপ্ত হতে চাইলে কেউ বাধা দেবে না। দু'হাজার চারে যাদের বয়স পঁচাত্তরের বেশি ছিলো তাদের অনেককেই জিজ্ঞেস করে দেখা গেল, --ওনারা কেউ 'বন্দে মা-ত-র-ম'-এর অর্থ জানেন না। তবে, না-ই বা জানলেন, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে স্বরাজ আন্দোলনের সমতলে সকলেই সমতালে ঐক্যবদ্ধ হতে পেরেছিলেন ঐ 'বন্দে মা-ত-র-ম' উচ্চারণের মধ্য দিয়ে।
বলা বাহুল্য, --শক্তি, শ্রম, বল, অর্থ, বিত্ত ইত্যাদির বিনিময়ে অমন ঐক্যবদ্ধতা অর্জন করা কখনোই সম্ভব নয়।
তখনকার 'বন্দে মা-ত-র-ম' উচ্চারিত বিপ্লবটি ছিল এই উপমহাদেশের তথা এই ভূ-মাতৃকার সার্বভৌমত্ব সেইসাথে তার সুরক্ষাকারী হিসেবে এই ভূখণ্ডের মানবসন্তানদের স্বাধিকার এবং স্বরাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে। ঐ বিপ্লবটি সফলতা পেয়েছে এবং যথারীতি আমরা স্বরাজ, স্বাধিকার, সার্বভৌমত্ব উপভোগ করে যাচ্ছি।
কিংবদন্তির ভূ-স্বর্গ তথা বর্তমানের ভূ-নরক কাশ্মীরকে গনণায় না-নিলে, --এই উপমহাদেশে স্বরাজ-স্বাধিকার-সার্বভৌমত্ব নিয়ে আজ কারো জটিলতা বা ভেজাল নেই। এমনকী, কুলাঙ্গার-নরাধমরাও তাদের কর্মকাণ্ড নিয়ে নিরাপদে আছে, --তারা নিজেদের মধ্যে মিলে-মিশে আছে। এখানে আজকের সমস্যা, এই ভূখণ্ডের সভ্য ভদ্র সকল মানবসন্তান সংক্রান্ত, --তারা ঐক্যবদ্ধ হতে পারছে না এবং প্রত্যেকে নিজস্ব চেতনাবোধের তীব্র চাপে নিজেই পিষ্ট হচ্ছে। সভ্য ভদ্র সচেতনেরা জনস্বার্থ অর্থাৎ সাধারণ জনগণের স্বার্থগুলোকে কেন্দ্র করে ঐক্যমত্য প্রকাশ করলেই, কুলাঙ্গাররা যে আড়ালে তলিয়ে যেতে বাধ্য হবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
আপনারা জানেন, --সেই স্বরাজ আন্দোলনের মাঝখানে হঠাৎ কিছু নরাধমের প্ররোচনায়, অন্যদেরকে দাবিয়ে নিজেরা উপরে উঠবার ঘৃণ্য বাসনায়, কুমন্ত্রণা ধারন করে করে জাত, ধর্ম, গোত্র, দল, জোট ইত্যাদি ইত্যাদি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সমষ্টির সৃষ্টি হয়েছিল। তখন থেকেই বিভেদ বিভক্তি আর কোন্দলে লিপ্ত থেকে থেকে নিত্য সমকালীন উন্নত বিশ্ব থেকে ক্রমবর্ধমান হারে পিছনে পড়ে পড়ে আমরা পঙ্গুত্বের দিকে যাচ্ছি তো যাচ্ছি। এভাবে চলতে দিলে, --খুব বেশি হলে সামনের দিকে আর মাত্র এক দশক, -তারপর কী হতে পারে, তা' আমি এ জন্যেই বলতে চাই না যে, আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, আমার চে' বরং আপনাদের ভাবনাই অবশ্যম্ভাবিতার বেশি কাছাকাছি।
'জয়', 'জিন্দাবাদ', 'লারায়ে', 'লালসালাম', 'নিপাতযাক', 'একহও' 'ইয়া-আলী' ইত্যাদি ইত্যাদি উচ্চারণগুলো গত এক শতাব্দীরও কম সময়ে, দলীয় দাঙ্গা বা সাম্প্রদায়িক কোন্দল বাড়াতে বাড়াতে এই উপমহাদেশটাকে এমন এক অবস্থায় নিয়ে গেছে যে, বর্তমান প্রজন্মের তরুণ যুবকরা সহজে বিশ্বাস করতে চাইবে না, --কোনো কালে এখানে, বহুজাতিক শান্তিপূর্ণ সহ-অবস্থানের এই ভূখণ্ডে, নিরস্ত্র জনগণ জাত-ধর্ম নির্বিশেষে সকলে মিলে সমস্বরে 'বন্দে মা-ত-র-ম' নিনাদের মাধ্যমে সমন্বিতভাবে স্বরাজ আন্দোলনে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল এবং অস্ত্রধারীদেরকে লেজ গুটিয়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য করতে পেরেছিল তারা। সেই সূত্র ধরে ভাবতে গেলেই দেখা যায়, লাঠি-সোটা-দা-কুড়াল-আগ্নেয়াস্ত্র-হানাহানি-রক্তারক্তি ঘটিয়ে কিংবা জ্ঞানে-বিজ্ঞানে-আদর্শে-নীতিতে-চেতনায়-আধ্যাত্মিকতায়-মানবতাবোধে-দেশাত্ববোধে জাগিয়ে তোলার মাধ্যমে এই ভূখণ্ডের সভ্য ভদ্র মানবসন্তানদেরকে ঐক্যবদ্ধ করা সম্ভব নয়, --বরং, বলতে পারেন, ঐকাত্ম্যকে ডেকে আনা সম্ভব কেবল সর্বজনগ্রাহ্য নিরপেক্ষ কোনো উচ্চারণের মাধ্যমে, --যেমন, --'বন্দে মানবসন্তান'।
-----------------------------------------------
করণিক : আখতার ২৩৯ ।
রঙ্গপুর : ০৮/০৫/২০১০।